বাংলাদেশের পতাকা মহাকাশে
Anika Nur |
আনিকা নূর পৌঁছে গেছেন ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে পৃথিবীর সেরা মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসা পর্যন্ত।একটি রকেটে মহাকাশে পাঠিয়েছেন বাংলাদেশের পতাকাও।কেমন ছিল সে পথ, খুব সহজ? মাত্র ৪ বছর আগে অভিবাসী হয়ে সপরিবারে পাড়ি জমিয়েছেন আমেরিকায়। এই ৪ বছরে একজন মানুষে কি করতে পারে, কতদূর যেতে পারে সেটা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক হতে পারে। বয়স এবং পরিবেশও হয়তো বিবেচনায় আসবে এই হিসেব করার ক্ষেত্রে। বিতর্ক হয়তো বহুদূর যাবে।কিন্তু বিতর্কের থেকে আমাদের আনিকা নূর আরও এগিয়ে।
যখন আমেরিকায় যান তখন তাঁর বয়স ১৯। আমেরিকায় গিয়েই অডজবে ঢুকেছেন। বাসার একমাত্র উপার্জনকারী সদস্য ছিলেন তিনি । একদিকে এইচএসসি’র রেজাল্ট খারাপ, অন্যদিকে ভার্সিটি এ্যাডমিশন নিতে পারছেন না। ভয়ংকর ডিপ্রেশনে। জিদ চেপে গেলো মনে। ভার্সিটির এ্যাডমিশনও নিলেন, সাথে ফুল-টাইম জব। ব্যাপারটা অনেক কঠিন ছিল। হঠাৎ করেই বিয়ে ঠিক হলো, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় চলে যেতে হলো। নিউইয়র্ক থেকে ফ্লোরিডা। এর মধ্যে SAT দিতে হলো। স্কলারশিপ নেই, লোন নিলেন হাই ইন্টারেস্ট রেটে। কারণ, কমপক্ষে ১ বছর না হলে সরকার অর্থ সহযোগিতা করে না। এর মধ্যে হাজব্যান্ড এর জব হলো অন্য স্টেটে। এবার ফ্লোরিডা থেকে কলোরাডো। তিনি তখন ভয়ংকর সমস্যায়, ফান্ড নেই কিন্তু অনেক টাকা লোন হয়ে গেছে। দেখলেন স্কলারশিপ ম্যানেজ করতে হবে, না হলে পড়াশোনা বন্ধ। কিন্তু তাঁর এখানকার কোন সার্টিফিকেট নেই। তিনিতো দমে যাওয়ার মেয়ে না। এবার ভলান্টারি কাজ করা শুরু করলেন। আমেরিকায় যাদের বৈধভাবে বসবাসের কাগজপত্র নেই, তাদের অংক আর ইংরেজী শেখানো শুরু করলেন। তারা আনিকা নূরের কথা কিছু বুঝতো না। স্প্যানিশ ডিকশনারি নিয়ে বসা লাগতো তাদের কে বুঝাতে। এই কাজ দেখিয়ে আমেরিকার ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন থেকে ১০ হাজার ডলার স্কলারশিপ পেলেন। ঐ সময় এটা তাঁর অনেক বড় প্রাপ্তি ছিল।তখন তাঁর মনে হলো, তাঁকে দিয়ে আরো ভালো কিছু হবে।
একদিন তাঁর ভার্সিটির নিউজ বোর্ডে নাসার একটা বিজ্ঞপ্তি দেখলেন। একটা প্রজেক্ট বানাতে হবে যেটা মহাকাশে যাবে। এই কাজটাতে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একটা টিম গঠন করলেন। প্রোগ্রামিং, ইলেকট্রনিক্স শিখলেন নিজে নিজে।তাঁর ফিল্ড বায়োকেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। সে হিসেবে বায়োলজি রিলেটেড কিছু করা তাঁর জন্য তুলনামূলক সহজ ছিল। কিন্তু কঠিন কাজ করার সিদ্ধান্ত যেহেতু নিয়েছেন, সেহেতু করতেই হবে এই ব্রতে অটল ছিলেন । তারপর নাসার সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো দেখা শুরু করলেন। দেখলেন ওরা ফাঙ্গি (ফাঙ্গাস) পাঠিয়েছে মহাকাশে- যেটার ৬০% সারভাইভ করেছে। তিনি দল সহ এর পরবর্তী ধাপ চিন্তা করা শুরু করলেন। ফাঙ্গি নিজের খাবার নিজে বানাতে পারে না। তাঁরা ভাবলেন, ফটোসিনথেসিস করে, এমন কিছু নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করি। তাঁরা নাসাতে এই প্রস্তাব দিলেন। তারা এটা গ্রহণ করে বড় একটা ফান্ড দিলো। কলেজ থেকে ল্যাবরেটরীতে কাজ করার অনুমতি মিললো, যেখানে প্রফেসররা ছাড়া আর কেউ যায় না। কিন্তু সেখানে তাঁরা ৪ জন গিয়ে কাজ করার অনুমতি পেলেন।
ততদিনে আবার ক্যাম্পাস স্টার হয়ে গেছেন।সেই সুবাধে কলেজেই ম্যাথ টিউটরিং এর একটা চাকরি মিলে গেলো। প্রি-এ্যালজেবরা থেকে ক্যালকুলাস 3 পড়াতেন। সময়গুলো ক্লাস, গবেষণা আর চাকরির মধ্যে ভাগ হয়ে গেলো। অর্থাৎ সিভি ভারী করা চেষ্টা চলতে লাগলো। ৪ মাস সময়কালের একটা গবেষণা নাসাতে পাঠালেন।‘হট এয়ার বেলুনে’ সেটা ১ লাখ ফিট দূরত্বের মহাকাশে পাঠানো হলো। একটা করে আরেকটা সার্টিফিকেট ও স্কলারশিপ পেলেন। নাসার ওয়েবসাইটে তাঁদের গবেষণাপত্র প্রকাশিত হলো।
‘রকঅন’ খুবই প্রতিযোগিতামূলক একটা ওয়ার্কশপ।ভবিষ্যতে মহাকাশে কিছু করার জন্য হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় এখানে। এবার পুরো আমেরিকা থেকে ৬৮ জনকে নিয়েছে ‘রকঅন’ ওয়ার্কশপে। সেখানে ফ্যাকাল্টি আছে, স্টুডেন্ট আছে,ইঞ্জিনিয়াররা আছে। তবে স্টুডেন্ট হিসেবে চান্স পাওয়া খুব কঠিন। তাঁদের টিমের ৪ জন থেকে তিনি একাই চান্স পেয়েছেন। ‘রকঅন’ এর কর্মশালায় টিমের সদস্যদের কাউকে আগে থেকে চিনতেন না। ৬ জনের টিমে আনিকা নূর একমাত্র মেয়ে ছিলেন। টিমে একজন আফ্রিকান ছিল, ইউক্রেনিয়ান ছিল একজন, ইন্ডিয়ান ছিল। এছাড়া বাকি সবাই আমেরিকান হোয়াইট। মেক্সিক্যান ২/৩ জন ছিল। কিন্তু তাদের জন্ম আমেরিকাতেই। তাঁদের কাজ ছিল সাউন্ডিং রকেট এর জন্য কিছু যন্ত্রাংশ প্রস্তুত করা। এর জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সরবরাহ করেছে নাসা। এটা ৭ দিনের একটা ওয়ার্কশপ ছিল।কিন্তু এটা অনেক কঠিন ছিল। কারণ, তাঁরা জানতেন না যে, কি করতে হবে।সবচেয়ে অবাক করা মূহুর্ত ছিল যখন তারা বললো যে, আনিকাদের রকেট বানানো দেখবো এবং রকেটের বডিতে তাঁরা স্বাক্ষর করতে পারবে। আসলে খুবই মূল্যবান মূহুর্ত এটা। আরো চমক অপেক্ষায় ছিল। রকেটে ১১ গ্রাম ওজনের মধ্যে কোন স্মারক (স্যুভেনির) পাঠানোর অনুমতি দেয়া হলো আনিকা নূরকে। আমাদের আনিকা নূর তখন বাংলাদেশের একটা ফ্ল্যাগ, আমেরিকার একটা ফ্ল্যাগ আর পরিবারের একটা ছবি দিলেন।
আটলান্টিকের ঠিক পাশে রকেট উৎক্ষেপন করা হয়েছে। ১৫০০ ফুট দূর থেকে তাঁরা সেটা দাঁড়িয়ে দেখেছেন। মহাকাশে প্রায় ৬ লাখ ফুট দূরত্বে পাঠানো হয়েছে রকেটটি। ঠিক সিনেমায় দেখা দৃশ্যের মতো। মাত্র ১০ সেকেন্ড তাঁরা দেখতে পেরেছি রকেটটা। এটাই হয়তো আনিকা নূরের জীবনের সেটা ১০ সেকেন্ড। উৎক্ষেপন করা রকেট আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছে। সেখানকার সব ডাটা কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীদের দেয়া হয়েছে। আনন্দের ব্যাপার হলো, তাঁদের গবেষণা করে যা যা তৈরি করেছিল মহাকাশে তার সবগুলোই কাজ করেছে। নাসার একমাত্র নোবেল বিজয়ী John C Mather তাঁদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে ক্ষান্ত হননি, কয়েকজনকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে আমাদের জাতীয় সঙ্গীত শুনিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের নামও শোনেনি এমন কিছু মানুষের কাছে একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি তুলে ধরতে পেরেছেন, আনিকা নূর যে রকেটের গায়ে সাক্ষর করেছেন, নাসা এটা সবসময় সংরক্ষণ করবে। এমনকি এটা তাপমাত্রা বা অন্য কোনভাবে নষ্ট হবে না। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় কিছু।
এরপর বেশ কিছু প্রজেক্ট থেকে তাঁর ডাকছে। কিন্তু কোনটার ব্যাপারে এখনো সিদ্ধান্ত নেননি। এগুলোর কোন একটাতে কাজ করবেন তিনি। আর তাঁর নিজেরও কিছু পরিকল্পনা আছে। টিনএজারদের নিয়ে কাজ করতে চান। ওদেরকে মহাকাশ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলার জন্য। এমন প্রোজেক্টে টাকা দেয় নাসা। আগস্ট পর্যন্ত সময় আছে। তিনি যতটুকু জানেন তা দিয়ে- এখনই শুরু করতে পারেন। কিন্তু তারপরও ভাবনার জন্য একটু সময় নিচ্ছেন তিনি। এটা কমপক্ষে এক থেকে দেড় বছরের কাজ। ভার্সিটি, চাকরি, সংসার-সবমিলিয়ে কতটা সময় বের করতে পারবেন তার উপর নির্ভর করবে সিদ্ধান্ত।’ আনিকা নূরদের পথ চলা আরও মসৃণ হোক, বাংলাদেশ কে আরও উপরে নিয়ে যাক এই কামনাই করি।
No comments
Leave a comment to inspire us.