হযরত আবু উসমান (রাঃ)
হযরত উসমান ইব্ন আফ্ফান (রাঃ)
উসমান ইব্ন আফফান (রাঃ) ইসলামের তৃতীয় খলিফা । তিনি মক্কার বিখ্যাত বানু উমায়্যা গোত্রে জন্মগ্রহণ করেন । তিনি এই বংশের আবুল আসীর পৌত্র ছিলেন । রাসূল (সঃ) এর নবুওয়ত লাভের প্রথম দিকেই হিজরাতের বেশ পূর্বে তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন । উমায়্যাগন অনেক পরে ইসলাম গ্রহণ করিলেও ব্যক্তিগতভাবে হযরত উসমান (রাঃ) এই সৎ সাহসের জন্য প্রসিদ্ধি লাভ করেন । তিনি একজন ধনী ব্যবসায়ী ( সেহেতু তাহকে উসমান গনী বলা হইত) এবং সামাজিক খ্যাতি ও যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন । তিনি সৌন্দর্য ও শালীনতার প্রতীক ছিলেন । রাসূল (সঃ) এর কন্যা রুকায়ার সহিত তাঁহার বিবাহ ইসলাম গ্রহণের পর সঙ্ঘটিত হয় এবং তিনি বিবাহের পর পত্নীসহ আবিসিনিয়ায় হিজরত করেন (শিবলী, সীরাতুন্নাবী ২খ, ৪২৬) । হযরত উসমান (রাঃ) আবিসিনিয়াতে মুসলিমগণের দুইটি হিজরাতেই অংশগ্রহণ করেন । তৎপর মদিনায় মুহাজিরগণের সহিত মিলিত হন। তাঁহার স্ত্রী পিড়িটা থাকায় তিনি বাঁদরের যুদ্ধে যোগদান করিতে পারেন নাই । হযরত রুকায়্যার (রাঃ) মৃত্যুর পর রাসূল (সঃ) হযরত উসমান (রাঃ) এর সহিত তাঁহার অপর এক কন্যা উম্মু কুলছুমের বিবাহ দেন । এই কারণে তাহাকে যুন-নুরাইন (দুই জ্যোতির অধিকারী) বলা হইত ।
হযরত উমার (রাঃ) ইন্তিকালের পূর্বে খলীফা নির্বাচনের উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট যে ছয়জন সাহাবীর সমন্বয়ে একটি মাজলিস গঠন করিয়াছিলেন হযরত উসমান (রাঃ) ছিলেন তাহাদের অন্যতম । তাহারা সর্বসম্মতিক্রমে উসমান (রাঃ) কে খলীফা পদে মনোনীত করেন । হযরত উসমান (রাঃ) তাঁহার খিলাফাতকালে কুরআন ও সুন্নাহ্র নীতি অনুসরণ করেন ।
হযরত উসমান (রাঃ) এর খিলাফাতের সপ্তম বৎসরে মুসলিমদের প্রথম অন্তবিরোধ আরম্ভ হয় । এবং স্বয়ং খলীফা এই বিরোধ বহ্নিতে শাহাদাত বরন করেন । আরব ঐতিহাসিকগণ এই ব্যাপারে খলীফার বিরুদ্ধবাদীগণের অভিযোগসমূহ লিপিবদ্ধ করিয়াছেন (আত-তাবারীকৃত আর রিয়াদুন নাদিরাঃ ফী মানাকিবিল আশারাঃ , কায়রো ১৩২৭ হিঃ, ২খ ১৩৭-১৫২ পুস্তকে ইহার বিস্তারিত আলোচনা আছে )। তাঁহার বিরুদ্ধে প্রথম এবং প্রধান অভিযোগ ছিল এই যে, তিনি তাঁহার আত্মীয় স্বজনগণকে প্রাদেশিক শাসঙ্কর্তার পদে নিযুখ করিয়াছিলেন । বাস্তবিকপক্ষে এই শাসনকর্তাদের অধিকাংশই উয্রত উমার (রা;) এর সময়েই নিযুক্ত হইয়াছিলেন । হযরত উমার (রাঃ) এর সময়েই প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণের স্বাতন্ত্র্য-প্রিয়তার জন্য তাহাদিগকে খলীফার ক্ষমতাধীনে রাখা ক্রমশ দুরূহ হইয়া উঠিতেছিল । কিন্তু হযরত উমার (রাঃ) তাঁহার ব্যক্তিত্ব প্রভাবে প্রাদেশিক শাসনকর্তাগনকেও আয়ত্তে রাখিতে সক্ষম হইয়াছিলেন । হজরত উসমানের নমনীয়তার সুযোগ লইয়া তাঁহার গোত্রীয় আত্মীয়-স্বজনগণ তাঁহার উপর প্রাধান্য বিস্তার করে । তাঁহার বিরুদ্ধে আর একটি অভিযোগ এই ছিল যে, তিনি বিজয়লব্ধ ধন-সম্পত্তির একাংশ তাঁহার আত্মীয় স্বজনকে দান করিয়াছিলেন । উসমানী খিলাফাতের পূর্বে যে মধ্যপ্রাচ্যের অমুসলিম দেশগুলির বিরুদ্ধে যে জিহাদ চলিতেছিল, তাহাতে যে “মালু’ল গানীমা” পাওয়া যাইত তাহা সমস্ত সৈনিকের মধ্যে বণ্টন করিয়া দেওয়া হইত । ইহা হইতে কিছু কিছু অংশ বিশেষভাবে বিশিষ্ট ব্যক্তিগণকে দেওয়া হইত । হযরত উসমান (রাঃ) জনগনের সম্পদ হইতে অন্যায়ভাবে কাহাকেও কিছু দেন নাই । ব্যক্তিগত সম্পদ হইতে অনেক সময় আত্মীয় স্বজনকেও দান করিতেন । হযরত উসমান (রাঃ) হযরত আবু বকর (রাঃ) সংগৃহীত কুরআন মজিদের প্রামাণ্য অনুলিপি প্রস্তুত করাইয়া প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণের নিকট পাঠাইয়া দেন এবং আঞ্চলিক পাঠ বৈষম্যযুক্ত অনুলিপিগুলি জ্বালাইয়া ফেলিতে আদেশ দেন । হযরত উসমান (রাঃ) এর এই কার্যের উদ্দেশ্য ছিল যে, বিস্তীর্ন মুসলিম খিলাফাতে প্রচলিত আরবী বাক-রীতির অনুপ্রবেশে যেন কুরআনে পাঠ-বৈষম্যের সৃষ্টি না হয় । অথচ ইহাকেও তাঁহার বিরুদ্ধবাদীরা আন্দোলনের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে ।
হযরত উসমান (রাঃ) এর সময়ে অশান্তির ঘটনা প্রবাহের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এইরূপঃ
হযরত উসমান (রাঃ) এর দ্বাদশ বর্ষব্যাপী খিলাফাতকাল দুই অংশে বিভক্ত । প্রথম ছয় বৎসরে (২৩-২৯) শান্তি বিরাজ করে এবং শেষ ছয় বৎসর (৩০-৩৫) অশান্তির কাল । এই বিদ্রোহ ও ষড়যন্ত্রের কেন্দ্র ছিল মিসর । সেই সমুদয় ইহুদী যাহারা শুধু মৌখিকভাবে লোক দেখানোর জন্য ইসলাম গ্রহণ করিয়াছিল । এই ষড়যন্ত্রকারী দলের নেতা ছিল মুসলমান ছদ্মবেশী ইহুদী সন্তান আব্দুল্লাহ ইবনে সাবা । সানআর অধিবাসী আব্দুল্লাহ ইব্ন সাবা ইসলাম গ্রহণের কিছুকাল পর মদিনায় আসিয়া বসবাস আরম্ভ করিল । হযরত আলী (রাঃ) এর নাম নিয়া হযরত উসমান (রাঃ) এর বিরুদ্ধে মুসলমানদিগকে উসকাইতে লাগিল । ইহার পর সে বসরায় গিয়া একই প্রক্রিয়ায় উসমান (রাঃ) এর বিরুদ্ধে জনসাধারণকে উত্তেজিত করিতে লাগিল । তারপর কুফা ও দামেস্কে গিয়া একই কাজ করিতে লাগিল । অবশেষে মিসরে পৌঁছাইয়া জনসাধারণকে এত উত্তেজিত করিয়া তুলিল যে, তাঁহারা উসমান (রাঃ) কে নিহত করাকেই জাতির স্বার্থে সর্ববৃহৎ কর্ম বলিয়া মনে করিতে লাগিল । কিছুকাল যাবত এইরূপ দুর্যোগের যে মেঘ পুঞ্জীভূত হইতেছিল ৩৫ হিঃ এর শেষে তাঁহার বইঃপ্রকাশ ঘটিল । বিভিন্ন প্রদেশের বিদ্রোহীগণ মদিনার দিকে যাত্রা করে । সর্বপ্রথম আসে মিসরীয়গণ । খলীফার সহিত সাক্ষাতে তাঁহার তাহাদের অভিযোগসমূহ অতিশয় তীব্র ভাষায় প্রকাশ করে । কিন্তু খলীফার নম্র এবং শান্ত ব্যবহারে তাঁহার প্রশমিত হয় । খলীফা তাহাদিগের সমস্ত দাবী মানিয়া লন ।
কিন্তু পথিমধ্যে আল-আরীশ নামক স্থানে হযরত উসমান (রাঃ) এর এক দূত ধরা পড়ে এবং তাঁহার নিকট একটি পত্র পাওয়া যায় । ইহা মিসরের গভর্নর আব্দুল্লাহ ইবনে সা’দের নিকট লিখিত ছিল । পত্রে আন্দোলনের এই নেতৃবৃন্দকে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর মৃত্যুদণ্ড দিতে কিংবা অঙ্গচ্ছেদ করিতে বলা হইয়াছিল । এই পত্র হস্তগত হওয়ায় ফলে বিদ্রোহীগণ ক্রোধান্বিত হইয়া প্রতিশোধ গ্রহণের উদ্দেশ্যে মদিনায় ফিরিয়া আসে ।
হযরত উসমান (রাঃ) এই পত্র তাঁহার লিখিত বলিয়া অস্বীকার করেন এবং ইহা তাঁহার শতুগনের দুরভিসন্ধিমূলক কার্য বলিয়া অনুমান করেন । অবশেষে লেখার পদ্ধতিতে ধরা পড়িল যে, ইহা মারওয়ানের লেখা । হযরত আলী (রাঃ) ও অপরাপর সাহাবাগন আপ্রাণ চেষ্টা করিলেন যাহাতে বিদ্রোহীগণ মদীনা ত্যাগ করিয়া চলিয়া যায় । বিদ্রোহীগণ বুঝিতে পারিল যে চিঠি সত্যই উসমানের (রাঃ) লেখা নয় । তথাপিও তাহারা উসমান (রাঃ) এর খিলাফাত ত্যাগের জন্য আন্দোলন চালাইয়া গেল । বিদ্রোহীগণ হযরত উসমান (রাঃ) কে গৃহে অবরুদ্ধ করিয়া রাখে । হযরত উসমান (রাঃ) বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করিতে সাহাবীগণকে নিষেধ করেন । কিন্তু তাহাদের কেহ কেহ আপন পুত্রগণকে হযরত উসমান (রাঃ) এর গৃহদ্বারে প্রহরী নিযুক্ত করেন । হযরত আইশা (রাঃ) এই সময়ে মক্কায় হাজ্জ করিতে গিয়াছিলেন । হযরত উসমান (রাঃ) নিজ মর্যাদায় অবিচলিত থাকিয়া ঘোষণা করিয়া দিলেন যে, তিনি কোন অবস্থাতেই খিলফাত ত্যাগ করিবেন না । কয়েকদিন এইরূপ অবরোধের পর কতিপয় ব্যক্তি ৩৫ হিঃ (জুন ৬৫৬) মুহাম্মদ ইব্ন আবী বকরের নেতৃত্বে খলিফার গৃহাভ্যন্তএর প্রবেশ করিয়া তাহাকে আক্রমণ করে । খলিফা এই সময় কুরআন পাঠ করিতেছিলেন । তাঁহার রক্ত কুরআনের উপর ছিটকাইয়া পড়ে । তাঁহার কাল্ব গোত্রীয়া স্ত্রী নাইলা বিন্ত ফুরাফিসা আহত হন । খলীফার শাহাদাতের পর রাত্রে অতি গোপনীয়তার সহিত তাঁহার মৃতদেহ কয়েকজন আত্মীয় দাফন করেন । মু’আবিয়া (রাঃ) সিরিয়া হইতে খলীফাকে সাহায্য করিবার মানসে একদল সৈন্য প্রেরণ করিয়াছিলেন । পথে খলফার নিহত হওয়ার সংবাদ পাইয়া আবার তাঁহার সিরিয়ায় ফিরিয়া যায় ।
এই হত্যাকাণ্ডের ফলে ইসলামের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় একতা নষ্ট হইয়া যায় এবং ধর্মীয় মতবিরোধ ও গৃহযুদ্ধের যুগ আরম্ব হয় । হযরত উসমান (রাঃ) এর খিলাফাত এবং ইহার রক্তাক্ত সমাপ্তি ইসলামের ইতিহাসে একটি করুন ও যুগান্তকারী ঘটনা ।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, হযরত উসমান (রাঃ) অত্যাধিক নির্মল চরিত্রসম্পন্ন ছিলেন এবং সরলপ্রাণ ব্যক্তি ছিলেন । নম্রতা, ধর্মপ্রানতা ইত্যাদি গুণাবলী তাঁহার চরিত্রের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল । কোরআন সঙ্কলনের বিশেষ অবদানের জন্য তাহাকে জা’মেউল কোরআন উপাধি দেয়া হয় । হাদিসে আছে রাসুলুল্লাহ (সঃ) বলিয়াছেন “ বেহেশতে প্রত্যেক নবীরই সঙ্গী থাকিবে । আমার সঙ্গী হইবে উসমান ।”
No comments
Leave a comment to inspire us.