Header Ads

আল ফারাবি

আল ফারাবি


আল ফারাবির নাম তোমরা হয়তো অনেকেই শুনেছ। ইসলামী রাষ্ট্রদর্শনের ইতিহাসে যে কয়জন মহান জ্ঞানসাধক প্রাচ্যের সেরা দার্শনিক রূপে খ্যাতি লাভ করেছেন আল ফারাবি তাদের অন্যতম। শুধু তাই নয়, ইসলামী দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, অধিবিদ্যা, বিজ্ঞান ও চিকিৎসাশাস্ত্রে আল ফারাবির অসামান্য জ্ঞানের জন্য এরিস্টটলের পরই তাঁর স্থান নির্দেশ করা হয়ে থাকে। এই কারণে প্রাচ্যের সুধীমহলে এরিস্টটল ‘মুয়াল্লিম আউয়াল’ বা প্রথম গুরু এবং আল ফারাবি ‘মুয়াল্লিম সানি’ বা দ্বিতীয় গুরু হিসেবে পরিচিত।

আজ থেকে প্রায় এগারো শ’ বছর আগের কথা। ঈসায়ী আট শ’ সত্তর সালের জুন মাস। এক সম্ভ্রান্ত তুর্কি বংশে আল ফারাবির জন্ম হয়। তাঁর প্রকৃত নাম আবু নসর মুহাম্মাদ ইবনে তুরান ইবনে উসলুগ। এশিয়ায় তুর্কিদের সভ্যতাকেন্দ্র ফারাব শহরের অন্তর্গত ওয়াজিস নামক স্থানে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ফারাবের অধিবাসী ছিলেন বলেই ‘ফারাবি আল তুর্কি’ খেতাব ব্যবহার করতেন। পরবর্তীকালে তিনি ‘আল ফারাবি’ নামেই সর্বত্র পরিচিতি লাভ করেন।

আল ফারাবি ছিলেন সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। তাঁর বাল্যকাল সচ্ছলতার মধ্য দিয়েই কাটে। বাল্যে পিতা ও অন্যান্য খ্যাতনামা শিক্ষাবিদদের পদপ্রান্তে বসে তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ইলম হাসিল করেন। তৎকালীন ঐতিহ্য অনুযায়ী তিনি চিকিৎসা বিষয়ে প্রভূত ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন। অল্প বয়সেই আল ফারাবি প্রাচ্যের তৎকালীন প্রধান শিক্ষাকেন্দ্র্র বাগদাদে পদার্পণ করেন এবং অল্পকালের মধ্যেই আরবি ও গ্রিক ভাষা আয়ত্ত করেন। অতঃপর তিনি প্লেটো ও এরিস্টটলের রচনাবলির তর্জমাকারী ও ভাষ্যকার আবু বিসর মিতাহ ইবনে ইউনুসের নিকট গ্রিক দর্শন অধ্যয়ন করেন। তাঁর নিকট গ্রিক দর্শন সম্পর্কে প্রাথমিক জ্ঞান লাভের পর আল ফারাবি যোহান ইবনে যিলাদ নামক আর একজন খ্রিষ্টান দার্শনিকের নিকট দর্শনতত্ত্ব সম্পর্কে গভীর জ্ঞান লাভ করেন। বাগদাদে তিনি সংস্কৃত, হিব্রু, এমরানি, মিশরীয় ইত্যাদি ভাষায়ও ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন।

আল ফারাবি বাগদাদে প্রায় ৪০ বছর অবস্থান করেন এবং এই সময়ের মধ্যে বাগদাদে মোট ছয়জন আব্বাসীয় খলিফার আবির্ভাব ঘটে। এভাবে ঘন ঘন খলিফা পরিবর্তনের ফলে বাগদাদে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার সূচনা ঘটে এবং এর ফলে বিরোধী শক্তিগুলো প্রবল হয়ে ওঠে। খলিফাদের দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে অনেকেই আখের গোছাতে থাকেন। খলিফাগণ প্রভাবশালী আমীর ওমরাহদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত হন। এই পরিবেশে বাগদাদে স্বাধীনভাবে জ্ঞানসাধনা করা আল ফারাবির পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। তিনি বাগদাদ ত্যাগ করে আলেপ্পোতে আমীর সায়ফুদ্দৌলার দরবারে গমন করেন। আমীর তাঁর গভীর পান্ডিত্যে মুগ্ধ হয়ে স্বীয় দরবারে তাঁকে আশ্রয় দান করেন। সে সময় আলেপ্পোতে বহু দার্শনিক, বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদের সমাবেশ ঘটেছিল। প্রকৃতপক্ষে আমীরের আন্তরিক পৃষ্ঠপোষকতার ফলে আলেপ্পো তখন জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্রভূমি হয়ে উঠেছিল। আল ফারাবির বাকি জীবন আলেপ্পোর রাজদরবারেই অতিবাহিত হয়েছিল। ধনরতেœর প্রতি তাঁর কোনো লালসা ছিল না। সুলতানের শান্তিপূর্ণ আশ্রয়ে তিনি যে নিরুপদ্রবে জ্ঞান সাধনার সুযোগ পেয়েছিলেন, তাঁর বিবেচনায় এটিই তাঁর শ্রেষ্ঠ প্রাপ্য।

একজন মহাজ্ঞানী দার্শনিক এবং ইসলামী দর্শনের উদগাতা হিসেবে আল ফারাবি অমর হয়ে থাকবেন। তিনি দর্শন অধিবিদ্যা, বিজ্ঞান, চিকিৎসাশাস্ত্র, গণিত ও সঙ্গীত বিষয়ে আরবি ভাষায় শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন বলে জানা যায়। তিনিই প্রথম ইসলামী বিশ্বকোষ ও মুসলিম তর্কশাস্ত্র রচনা করেন। এ ছাড়াও প্লেটো ও এরিস্টটলের মূল রচনাবলির ওপর তিনি প্রচুর ভাষ্য লিপিবদ্ধ করে গেছেন। তাঁর রচনাবলির মাধ্যমেই পরবর্তী মুসলিম দার্শনিকগণ গ্রিক দর্শনের সাথে পরিচিত হতে পেরেছিলেন। তিনি রাষ্ট্রতত্ত্বের ওপরও চারটি মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন‘সিয়াসাতুল মাদানিয়া’, ‘আরা উআহ লিল মাদিনাতুল ফাযিলাহ’, ‘যাওয়াসিউস সিয়াসত’, ‘ইযতিমাআতুল মাদানিয়া’ প্রভৃতি। তিনি প্লেটোর আইনতত্ত্বের (খধংি) একটি সংক্ষিপ্ত সংস্করণ রচনা করেন। তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে সিয়াসত ও ‘আরা’ সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।

সিয়াসত নামক গ্রন্থে আল ফারাবি মানুষ ও পশুর প্রভেদ, আদর্শ নগরী, আদর্শ রাষ্ট্রপ্রধানের প্রয়োজনীয়তা ও গুণাবলি, রাষ্ট্রেও শ্রেণীবিভাগ বিষয়ে আলোচনা করেছেন। আরা উআহ লিল মাদিনাতুল ফাযিলাহ গ্রন্থে সার্বভৌমত্ব, চুক্তিতত্ত্ব সাম্যতত্ত্ব, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।

এরিস্টটলীয় দর্শনের একান্ত ভক্ত হওয়া সত্ত্বেও আল ফারাবি তাকে অনুসরণ করেননি। তিনি এরিস্টটলীয় দর্শনের একজন ভাষ্যকার ছিলেন মাত্র। নিজের বিচার বুদ্ধির প্রয়োগ দ্বারা তিনি প্রয়োজনমত স্বতন্ত্র পন্থা বেছে নিতে কুণ্ঠিত হননি। উচ্চস্তরের দার্শনিক হয়েও তিনি একজন নিষ্ঠাবান মুসলিম ছিলেন। তাঁর সকল রচনার ভেতর এর পরিচয় লক্ষ্য করা যায়। যুক্তিবিদ্যায় ফারাবির প্রধান অনুরাগ ছিল। তাঁর মতে, যুক্তি সত্য ও মিথ্যার মধ্যে প্রভেদ সৃষ্টি করে মানুষকে অজানাকে জানতে সাহায্য করে। ফারাবির মতে সত্য যৌক্তিক বিচার বা বাক্যকে স্বতঃসিদ্ধরূপে গণ্য করা যেতে পারে। যেগুলো স্বচ্ছ, স্পষ্ট এবং সেগুলোকে সত্য বলে প্রমাণের দরকার পড়ে না। যেমন সমগ্র তার অংশ হতে বৃহত্তর অথবা দু’টি পরস্পরবিরোধী ধারণার মধ্যে একটি সত্য অপরটি অবশ্যই মিথ্যা। এসব স্বতঃসিদ্ধের মধ্যে বিরোধ সূত্রটি (খধি ড়ভ পড়হঃৎধফরপঃরড়হ) সর্বোচ্চ স্থানীয়। এই সূত্রের সাহায্যে অতি সহজইে সত্য-মিথ্যার মধ্যে তফাৎ নির্ণয় করা যায়। ফারাবি যুক্তিবিদ্যা ও জ্ঞানতত্ত্বকে এক ও অভিন্ন মনে করতেন।

প্রকৃতি বিজ্ঞান এবং আবহ বিজ্ঞান সম্পর্কে আল ফারাবি লিখেছেন। আকাশের গ্রহ নক্ষত্র ও জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর গতি প্রকৃতি সম্পর্কে গবেষণা করে তিনি জ্যোতির্বিজ্ঞানে মূল্যবান প্রবন্ধ লিখেছেন। এ ছাড়া রেখাশাস্ত্র (মবড়সধহপু), স্বপ্নতত্ত্ব (উৎবধস) ও জিন জগৎ নিয়েও তিনি প্রবন্ধ রচনা করেছেন। সঙ্গীত বিজ্ঞানে তাঁর এহসাউল উলুম এবং কিতাব আল মিউজিক আল কবীর যুগান্তকারী গ্রন্থ।

আল ফারাবি এক যুগস্রষ্টা দার্শনিক ছিলেন। মুসলিম বিজ্ঞানীদের মধ্যে আল ফারাবির অবদান কৃতিত্বের দাবি করতে পারে। তাঁকে পরবর্তীকালে মুসলিম দার্শনিকদের পিতা বলে অভিহিত করা হয়ে থাকে। তার সার্বভৌমত্বের ধারণা ও সামাজিক চুক্তি মতবাদের ধারণা বহু শতাব্দী পরেও পাশ্চাত্যে আধুনিক বলে পরিগণিত হচ্ছে। জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় আল ফারাবির অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য তাঁকে দ্বিতীয় এরিস্টটল বলা হয়ে থাকে।

এগারো শ’বছরেরও ওপর হলো আল ফারাবি ধরাধাম ত্যাগ করেছেন কিন্তু আজও তাঁর নিম্নোক্ত বাণীর মহিমা অবদান করছেঃ

“বৃক্ষের সার্থকতা যেমন ফল ধারণে, সে রকম নৈতিক গুণাবলির সার্থকতা পরম শান্তি লাভে। অতএব চরম ও পরম শান্তি লাভের একমাত্র পথ হচ্ছে ক্রমাগত সৎ জীবন যাপন করা।”

No comments

Leave a comment to inspire us.

Powered by Blogger.