কাফন রহস্য (কার্বন ডেটিং)
অনেকদিন পর গ্রামে এসেছে রাতুল। ব্যস্ততার কারণে তেমন একটা গ্রামে যাওয়া হয়না তার। ভার্সিটি মানেই শুধু ক্লাস, আর টিউটোরিয়াল। দিনরাত শুধু ব্যস্ততা আর ব্যস্ততা। এখন নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে তার। অনেকদিন পর নদী তীরে বসে হিমেল বাতাসে মন জুড়ানো, খুব ভাল লাগছে তার। হঠাৎ সে শুনতে পেল, কেউ তাকে ডাকছে, “এই রাতুল, কবে এলি ?” মুন্না। তার স্কুলের বন্ধু।
“এইতো আজ সকালে, তোর কি খবর?”
“আছি , ভালোই। গ্রামের খবর কিছু জানিস?”
“নাতো…কেন? কি হয়েছে?”
“ঐ যে গত সপ্তায় সুজনের দাদু মারা গেল না? তোকে তো বলেছিলাম, তুই তো এলি না।”
“হুম, জানি……… তো”
“কবর খুঁড়তে গিয়ে এক পর্যায়ে একটা কাফনের কাপড়ের প্রান্ত বেরিয়ে আসে। ”
“নতুন কবর হবে হয়তো।”
“এটাই তো সমস্যা, কবরটা অনেক পুরানো, কিন্তু কাফন এখনো সেই আগের মতোই, কবরটা কার কেউ বলতে পারছে না। অনেক বয়স্ক মুরুব্বীরাও দেখেছে, কেউ বলতে পারছে না এটা কার কবর বা কত বছর আগের। কেউ বলছে ৫০০ বছর আবার কেউ কেউ বলছে ২৫০ বছর আগের। সবারটাই অনুমান, তোর কি মনে হয় রাতুল?”
“ওটা কি এখনো আছে?”
“হুম”
“তাহলে সুজনের দাদুকে কোথায় দাফন করলো?”
“ওটার পাশেই, একটু সামনে। যাবি নাকি দেখতে? ”
“চল।”
তারা কবরস্থানের দিকে হাঁটা ধরলো। কবরের আশে পাশে অনেক ভিড়। রাতুল খুব অবাক হলো, এত পুরনো কবর অথচ কাফন এখনো নতুনের মতো।
“মুন্না, আমি কিন্তু বলতে পারব ওটা কত বছর আগের”
“কিন্তু কিভাবে?”
“তুই শুধু আমাকে সামান্য কাপড় নিয়ে দে ঐ কবর থেকে”
“না বাবা, আমি পারব না, তাছাড়া এত মানুষ এখানে, আর হুজুর সবাইকে নিষেধ করেছে ওখানে নামতে”
“তাহলে আমরা রাতে আসি, এখন চল। তোকে নামতে হবে না , আমিই নামবো, তুই শুধু আমার সাথে থাকবি”
রাত প্রায় পৌনে ১২ টা। চারদিকে অন্ধকার। গ্রামে ১০ টা মানেই গভীর রাত। রাতুল আর মুন্না রওয়ানা দিলো কবরস্থানের দিকে।
এতক্ষণ তার ভয় লাগেনি। কিন্তু কবরে নামার সময় হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে তার। শেষ পর্যন্ত অবশ্য কাপড় নিয়েই ঘরে ফিরল তারা। “এখন কি করবি?” মুন্না জিজ্ঞেস করলো। “শহরে গিয়ে কিছু কাজ করতে হবে। কাজ শেষ হলে তোকে জানাবো। এখন বাড়ি গিয়ে ঘুমা, সকালে কথা হবে।” এই বলে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল রাতুল।
পরদিন সকাল ১০ টা।
“কিরে রাতুল, তোর হাতে ব্যাগ কেন?” মুন্না জিজ্ঞেস করলো।
“চলে যাচ্ছি, ভেবেছিলাম কয়েকটা দিন থাকবো, কিন্তু ভাল লাগছে না। কাজটা শেষ না করা পর্যন্ত খুব অস্থির লাগছে। যাইরে মুন্না। ভাল থাকিস।”
রাতুল জানে যে সমস্ত প্রাণী বা উদ্ভিদ কার্বন গ্রহন করে জীবিত অবস্থায় তাদের দেহে কার্বন-১৪ আর কার্বন-১২ আইসোটোপের অনুপাত সমান থাকে। মারা যাওয়ার পর কার্বন-১৪ আইসোটোপ ধীরে ধীরে কার্বন-১২ তে পরিণত হয় আর তা তেজস্ক্রিয়তার ক্ষয় সূত্র মেনে চলে। এখন তার কাজ হবে ঐ পুরনো কাফনের কাপড়টিকে অনুরূপ নতুন কাপড়ের সাথে তুলনা করে দেখা, পুরনোটার কত ভাগ কার্বন-১৪ ক্ষয় হয়ে গেছে।
চিত্রঃ কার্বন-১৪ ক্ষয়ের হার
রাতুল তার এক ফ্রেন্ডকে দিল এটা বের করতে। তার ফ্রেন্ড কেমিস্ট্রি নিয়ে নিয়ে পড়ছে।
পরদিন রাতুল জানলো যে সেই কাফনের মাত্র ৮.৭% কার্বন-১৪ ক্ষয় হয়েছে, অর্থাৎ এখনো অক্ষত আছে ৯১.৩% কার্বন-১৪।
এবার রাতুল তার কাজ শুরু করলো।
সে জানে, তেজস্ক্রিয়তার ক্ষয় সূত্র অনুসারে,
“কোন নির্দিষ্ট সময়ে তেজস্ক্রিয় পরমাণুর ভাঙ্গনের হার ঐ সময়ে অক্ষত পরমাণুর সংখ্যার সমানুপাতিক”
অর্থাৎ, – d N/d t ∝ N , এখানে N হল t সময়ে অক্ষত পরমাণুর সংখ্যা। ক্ষয় বুঝাতে ঋণাত্মক চিহ্ন দেওয়া হয়েছে।
বা, – d N/d t = k N , যেখানে k সমানুপাতিক ধ্রুবক।
বা, d N/ N = – k d t
সমাকলন করে পাই,
l n (N) = – k t + A , এখানে A সমাকলন ধ্রুবক।
বা, N = B e^(- k t)————–(১) যেখানে, B = e^A = ধ্রুবক
সময়ের শুরুতে অর্থাৎ যখন t = 0 তখন, N = No = আদি পরমাণুর সংখ্যা , (১) থেকে পাই,
B = No
সুতরাং,
N = No e^(- k t)………………(২)
আবার কার্বনের অর্ধায়ু হল আনুমানিক ৫৭৩০ বছর । অর্থাৎ, ৫৭৩০ বছর পর কার্বন-১৪ অর্ধেক ক্ষয় হয়ে যায়।
এক্ষেত্রে, যখন t =৫৭৩০ বছর তখন No/N = ১০০/৫০ = ২ বা, N/No = ১/২ =০.৫
(২) থেকে পাই,
০.৫ = e^(- ৫৭৩০ k)
বা, – ৫৭৩০ k = l n (০.৫)
বা, k = ০.০০০১২০৯৬৮
(২) থেকে পাই,
N = No e^(- ০.০০০১২০৯৬৮ t)…………(৩)
এখন কাফনের কাপড়ে N/No = ৯১.৩/১০০ = ০.৯১৩
তাহলে (৩) থেকে পাই,
N/No = e^(- ০.০০০১২০৯৬৮ t)
বা, ০.৯১৩ = e^(- ০.০০০১২০৯৬৮ t)
বা, – ০.০০০১২০৯৬৮ t = l n (০.৯১৩)
বা, t = ৭৫২.৪২৫
অর্থাৎ , কাফনটি প্রায় ৭৫২ বছর পুরনো।
প্রায় সাথে সাথেই ফোনটা বেজে উঠলো। মুন্না ফোন করেছে।
“হ্যালো, মুন্না। বল”
“কিরে, তোর কাজের কি হল?”
“কাজ শেষ, কাফনটি প্রায় সাড়ে সাতশ বছরের পুরনো।”
“কি বলিস? এত পুরনো? কিন্তু কীভাবে?”
“ক্যালকুলাস বুঝিস?”
“তুই তো জানিস আমি কমার্সের ছাত্র।”
“তাহলে তোর বুঝা লাগবে না”, এই বলেই ফোনটা কেটে দিলো রাতুল।
No comments
Leave a comment to inspire us.